বাংলাদেশের তাঁত শিল্প ঃ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার পালা
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প হস্তচালিত তাঁত শিল্প। আমাদের অর্থণীতিতে এর ভূমিকা ব্যাপক। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালের তাঁত শুমারীতে এই শিল্প প্রায় ৪৭,৪৭৪ কোটি মিটার কাপড় উৎপাদিত করে যা আমাদের চাহিদার প্রায় ২৮ ভাগ পূরণ করে থাকে। তাঁতশিল্পীরা অসামান্য অধ্যবসায়, পরম মমতায়, যুগযুগ ধরে লালিত, বংশপরম্পরায় অসাধারন দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বয়ন উৎকর্ষতায় এ দেশের তাঁতশিল্পকে তুলেধরেছিল এক অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও এই শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। অতীতে এবং বর্তমানে তাঁত শিল্পে উৎপাদিত পোশাক রপ্তানি করা হয় বিশ্ব বাজারে। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থণীতিতে এর মূল্য সংযোজন প্রায় ২২৬৯.৭০ কোটি টাকা।
বৈচিত্রময় গ্রামীণ অর্থণীতির সবচেয়ে পুরনো মাধ্যম এর একটি আমাদের তাঁত শিল্প।বাংলাদেশের তাঁত শিল্প ও তাঁত শিল্পীরা আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।এই শিল্পের সাথে জড়িত আছে এদেশের সংস্কৃতি। বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ক্রম-বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে নানা মত রয়েছে তবে এই শিল্পের ইতিহাস অনেক প্রাচীন, এই নিয়ে কোন দ্বিমত নেই।আদিকাল থেকে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে চলে আসা আমাদের তাঁতশিল্প দেশে ও বিদেশে সমভাবে সমাদৃত।একসময় হাতে কাটা সূক্ষ্ম সুতা হত এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে হস্তচালিত তাঁতের কাপড় বোনা হত। সুলতানি ও মোগল যুগের উত্তরাধিকারী হিসাবে এখানকার তাঁতিদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা । এক সময় এদের পূর্বপুরুষরাই মসলিন, জামদানি ও মিহিসুতি বস্ত্র তৈরি করত। দিল্লির মোগল দরবার থেকে বৃটেনের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত এই মসলিনের কদর ছিল বেশ। বাংলার জগদ্বিখ্যাত মসলিন সারা বিশ্বে বাংলার গৌরব বৃদ্ধি করেছিল।এখনো দেশের তাঁত শিল্পীদের তৈরি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাওয়েঁর ঐতিহাসিক জামদানী, রাজশাহীর রেশমী বা সিল্ক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, কুমিল্লার খাদি বা খদ্দর, পাবনা ,সিরাজগঞ্জের লুঙ্গী ও গামছা, ঢাকার মিরপুরের বেনারসি, সিলেট ও মৌলভীবাজারের মনিপুরি তাতঁ ও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির তাতেঁর রয়েছে বিশ্ব ব্যাপী চাহিদা ও কদর।
এ শিল্পের সাথে তাঁতিসহ প্রত্যক্ষভাবে প্রায় নয় লক্ষ লোক নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়াও ডিজাইনার, তাঁত ব্যবসায়ী, তাঁত উদ্যোক্তা, তাঁতে সুতা, রং ও রসায়ন সরবরাহকারী, আমদানি ও রপ্তানিকারকসহ বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে এর স্থান কৃষি ও গার্মেন্টস শিল্পের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কৃষির পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম। গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এবং মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তাঁত শিল্পের ভূমিকা অনন্য। ২০১৮ সালে দেশব্যাপী পরিচালিত তাঁত শুমারি অনুযায়ী দেশে বিদ্যমান ১,১৬,১১৭টি তাঁত ইউনিটে মোট হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা ২,৯০,২৮২টি। তন্মধ্যে চালু তাঁতের সংখ্যা ১,৯১,৭২৩টি এবং বন্ধ তাঁতের সংখ্যা ৯৮,৫৫৯টি।
টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প এর একক বৈশিষ্টর জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদ্দিত। টাঙ্গাইল শাড়ির তাতীরা বিশেষ দক্ষতার মাধ্যম টাংগাইল শাড়ি তৈরী করে। পাটাইল ইউনিয়নের বসাক সম্প্রদায় সব থেকে পুরোন সম্প্রদায় যারা এখনো আদি ও ঐইতিহ্যবাহীতার সাথে তাঁতের শাড়ি তৈরী করে। এই শাড়ি তারা বাজিতপুর ও করটিয়া হাটে সপ্তাহে দুই দিন বিক্রি করে ।
নানা প্রতিকূলতায় অনেকটা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তাঁত শিল্প। আবহমান বাংলার তাঁতের শাড়ি এ দেশের কুটির শিল্পের অন্যতম একটি উপকরণ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অসুবিধার কারণে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
তাঁত, রঙ ও অন্যান্য কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি, মজুরীহার অত্যন্ত কম হওয়ায় ও পরিবহন সুবিধার অব্যবস্থার কারণে টাংগাইল তাঁতশিল্পসহ এই ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প ঝুকির সম্মুখিন হচ্ছে। এ কারণে অনেক তাঁতী এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে এবং অন্যত্র চলে যাচ্ছে।১৯৯০ সালে নরসিংদী জেলায় সবচেয়ে বেশি ২০ হাজারের মতো তাঁত ছিল। বর্তমানে তা কমে টিকে আছে মাত্র প্রায় এক হাজার। কুটির শিল্প হিসেবে হস্তচালিত তাঁত শিল্প ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বহির্বাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল। বংশপরম্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বয়ন উত্কর্ষতায় তাঁতিরা সৃষ্টি করেছিল এক অনন্য নিদর্শন।সুপ্রাচীকাল থেকে সিরাজগঞ্জের শাড়ি এ দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে আসছে। সিরাজগঞ্জের দক্ষ কারিগরেরা বংশানুক্রমে এ শাড়ি তৈরী করছেন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ কাহিনীতে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের শাড়ির কথাটি উল্লেখ রয়েছে। দেশের শাড়ি ও লূঙ্গি, গামছা ও বিভিন্ন পোশাকের সিংহভাগ পূরণ করছে পাবনা সিরাজগঞ্জের তাঁতের তৈরি লুঙ্গি শাড়ি ও পোশাক। তাই তাঁত শিল্প রক্ষায় এ শিল্পের জন্য সুতাসহ সব উপকরণের সহজলভ্যতা ও বিনা সুদে পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সাথে তাঁত শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং তাঁত শিল্পের অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত জরুরী।
আসুন তাঁতি ও তাঁতশিল্প রক্ষায় আমরা সবাই এগিয়ে আসি। দেশীয় ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের প্রচার প্রসার করি । নিজে পড়ি ও অন্যকে পড়তে উৎসাহিত করি।
পাবনা সিরাজগঞ্জের লুঙ্গি কিনতে ভিজিট করুন
তথ্য সূত্র:
২. তাহিতী ব্লগ
৩. বণিক বার্তা
৪. উইকিপিডিয়া
৫. অন্যান্য তথ্যসূত্র
৬. ইন্টারনেট।